Blogger templates

*********WHAT*********

আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে গিয়াউদ্দিন সাহেবের লেখা ‘মরণসঙ্গীত’ ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’। প্রায়ই ভাবি আমি মারা গেছি। শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর আবেগে গাইছে ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়।’ ‘নক্ষত্রের রাত’ নামের ধারাবাহিক নাটকের শুটিং ফ্লোরে আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। এবং একজনকে দায়িত্ব দিলাম গানটি বিশেষ সময়ে গাইতে। সে রাজি হলো। উৎসর্গপত্রের মাধ্যমে তাকে ঘটনাটি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা সময় এসে গেছে।

মেহের আফরোজ শাওন
চলে যায় বসন্তের দিন, হুমায়ূন আহমেদ, ২০০২, উৎসর্গপত্র



উল্লিখিত গানটি আমি প্রথম শুনি গায়ক সেলিম চৌধুরীর কণ্ঠে। ১৯৯৫ সালের কথা। তখন ডিএফপি-তে বিশাল সেট ফেলে ‘নক্ষত্রের রাত’ ধারাবাহিকের শুটিং করছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। শুটিংয়ের অবসরে প্রায়ই গল্পের আসর বসত, সঙ্গে থাকত সেলিম চৌধরীর গান। ‘আইজ পাশা খেলবরে শ্যাম’ গানটি গেয়ে সেলিম চৌধুরী তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তাঁর গাওয়া এই গানটি ছিল হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত পছন্দের। ডিএফপি-র এক সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বললেন, শুনেছি তুমি নতুন কুঁড়িতে গানে প্রথম পুরস্কার পেয়েছ। দেখি শোনাও তো কেমন গাও।

আমি রাগভিত্তিক একটি নজরুলসঙ্গীত গাইলাম। তিনি বললেন, ‘আইজ পাশা খেলবরে শ্যাম’ গানটা জানো?
না।
সেলিম, গানটা গাও তো।
সেলিম ভাই শোনালেন তার সেই বিখ্যাত গান। হুমায়ূন আহমেদ মাথা নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে গানের সঙ্গে তাল দিলেন।
গান শেষে আমাকে বললেন, এই গানটি গলায় তুলে আমাকে শুনিয়ে তো।
এখন শোনাব?
এখনই শোনাতে পারবে?
অবাক হলেন তিনি। আমি গান গেয়ে শোনালাম। মাত্র একবার শুনেই কোনো গান যে গলায় তোলা যায় এই বিষয়টা হুমায়ূন আহমেদকে খুবই অবাক করল। সেদিন তিনি আমার নাম দিয়েছিলেন ‘টেপরেকর্ডার’। এরপরই প্রায়ই গানের আসরে তিনি আমার পরীক্ষা নিতেন। নতুন কোনো গান শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘প্লে।’ আমি গানটি কিছুদূর গাওয়ার পর বলতেন, ‘স্টপ।’ তারপর তাঁর নতুন ‘টেপরেকর্ডার’ আবিষ্কারের গল্প অন্যদের শোনাতেন। আমার গান শুনে কেউ প্রশংসা করলে তাঁর গর্বিত মুখ দেখে মনে হতো যেন তিনিই আমাকে গান শিখিয়েছেন। একবার শুনেছি কোনো গান হুবহু গাইতে পারার সামান্য গুণটি কেন জানি হুমায়ূন আহমেদকে খুব মুগ্ধ করেছিল। একে একে রবীন্দ্রনাথের ‘চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে’, ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘তোমাকেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, নজরুলের ‘পথহারা পাখি’, ‘জনম জনম তব তরে কাঁদিব’ সহ হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় চমৎকার সব গানে সমৃদ্ধ হতে থাকল আমার গানে ঝুড়ি।
হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদ আমার গান শোনা বন্ধ করে দিলেন। বেশ কিছুদিন পর আমার হাতে এল একটি চিরকুট
তোমার গান কতদিন হলো শুনছি না।
গান শুনলেই বিষাদে আক্রান্ত হই। আমি
এমনভাবে গান শুনতে চাই, যেন সেই সময় আশপাশে
কেউ থাকবে না। শুধু আমরা দুজন। কোনো ভান না,
কোন ভনিতা না
দেখব শুধু মুখখানি
শুনব যদি শোনাও বাণী...
‘নক্ষত্রের রাত’ নাটকের সেটে একদিন সেলমি চৌধুরী গিয়াসউদ্দিনের সেই বিখ্যাত গানটি গেয়ে শোনালেনÑ ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে জাদুধন’। গান শেষে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, এটা আমার মৃত্যুসংগীত। এই গানটা এখন শাওনের গলায় শুনব। তার গান শুনে যদি আমার চোখে পানি আসে, তাহলে তার জন্যে পুরস্কার আছে।
পুরস্কার হিসাবে তাঁর মৃতদেহের পাশে বসে উল্লিখিত গান শোনানোর গুরুদায়িত্ব পেলাম।
Humyen
শাওন,
তুমি কি জানো তোমার গান
আমার কত পছন্দ?
এবং তোমাকে আমার কত পছন্দ?
আমার গান হুমায়ূন আহমেদের কেন যে এত পছন্দ ছিল তা আমি কখনোই পুরোপুরি বুঝে উঠেনি। আমার এই প্রশ্নে তিনি একেক সময় একেক উত্তর দিতেন। আমার মা সবসময়ই আমার গান পছন্দ করতেন। তাঁর আগ্রহেই আমি গান শিখেছি। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের মতো একজন ভক্ত পেয়ে গানের প্রতি আমি আরও যতœশীল হই। তাঁর মতো করে আমার গানকে ভালোবাসতে শিখি। তাঁর চলচ্চিত্র ও নাটকগুলোতে আমার গাওয়া গান স্থান পেতে থাকে।
‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের আগে কুসুম চরিত্রটি নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য তিনি আমাকে উপন্যাসটি পড়তে বলেন। পড়তে গিয়ে উপন্যাসের নায়ক মতি মিয়ার গানের একটি লাইন আমার মাথায় পোকার মতো ঢুকে যায়Ñ ‘কে পরাইল আমার চউক্ষে কলঙ্ক কাজল?’
মাথার পোকাটি বারবার আমাকে বলতে লাগল, ‘এখানে তো তোমার কথাই বলা হচ্ছে। গানের লাইনটা আসলে হবে- ‘কে পরাইল শাওনের চউক্ষে কলঙ্ক কাজল?’ হুমায়ূন আহমেদকে অনুরোধ করলাম এই এক লাইনের গানটা সম্পূর্ণ করতে। তিনি শর্ত দিলেন, গানটা যদি আমি গাই তবেই গানের বাকি অংশ লিখবেন।
সম্পূর্ণ গানটি লেখা হলো, সুর দিলেন হুমায়ূন আহমেদের প্রিয় সুরকার মকসুদ জামিল মিন্টু, গাইলাম আমি। গান শুনে ‘কিন্নরকণ্ঠী’ বিশেষণে আমাকে বিশেষায়িত করলেন তিনি।
কিন্নরকণ্ঠী,
মুগ্ধ হয়ে গান শুনলাম। পরম করুণাময় তোমাকে যে
সুর দিয়েছেন (যে দয়া তোমাকে করেছেন), সবসময়
সেই দয়ার কথা মনে রাখবে। তোমার অপূর্ব সুরের
জন্যে আমি এই মুহূর্তে তোমার দশটা অপরাধ
(ভবিষ্যতে যা করবে) ক্ষমা করলাম।
হুমায়ূন আহমেদ
১০-০৪-৯৯
Ahmed-
বিয়ের পর হুমায়ূন আহমেদ আমাকে গায়িকা শাওন বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই বেশি পছন্দ করতেন। অভিনেত্রী শাওন, পরিচালক শাওন কিংবা স্থপতি শাওন খুবই কম বলতে শুনেছি। খুব আয়োজন করে একদিন গান শিখতে বললেন গায়িকা শাওনের কাছে।
‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা
কহো কানে কানে শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।’
আধ ঘণ্টায় এই দুই লাইন গাইলেন বেশ কয়েকবার। তারপরÑধুর! আমার গলায় সুর নেই।Ñএই বলে রণে ভঙ্গ দিলেন।
নুহাশপল্লীর বেশির ভাগ জোছনারাতে দীঘি লীলাবতীর শ্বেতপাথরের ঘাট কিংবা পানিবিহীন সুইমিংপুলের ভেতর বসত গানের আসর। সঞ্চালক হুমায়ূন আহমেদ শিল্পী শাওন, শ্রোতা হুমায়ূনের বন্ধুদল Old Fools Club-এর সদস্য এবং তাদের স্ত্রীরা। চাঁদ ওঠার পর থেকে একের পর এক গান হতো চাঁদ ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। সেই সময় হুমায়ূনের প্রিয় কিছু গান ছিল, সেগুলোর সাথে তিনি গলা মেলাতেন। যেমনÑ
‘আমরা পুতুলওয়ালা যাই বেচে যাই
কে নেবে এসো বলে কী রঙ চাই
নগর প্রান্তরে অজানা পথ ধরে
সকাল সাঁঝে পুতুল বেচে যাই।
মাটির মানুষ মাটিতে মিশে
যেতে হবে দিনের শেষে’।

অথবা

‘আগুন লাগাইয়া দিল কোনে
হাসন রাজার মনে
নিভে না দারুণ আগুন জ্বলে দিল ও জানে।’
কখনো কখনো অভিনেতা স্বাধীন খসরুর গান হতো। তার গানে মাঝে
হুমায়ূনসহ Old Fools Club-এর সবাই কোরাস ধরতেন।

স্বাধীন : পাহাড়ে পাহাড়ে নগরে বন্দরে
খুঁজিয়া তোমারে ধারা বহাব।
কোরাস : আমি তারই আশায় যদি তারে পাওয়া যায়
আমি তারই আশায় যদি তারে পাওয়া যায়
স্বাধীন : নইলে এই ভবে মরিয়ারে যাব
বন্ধুরে...।
আহা, কী সুন্দরই না ছিল সেইসব দিন।
Old Fools Club-এর বিদেশি সহস্র হুমায়ূন-বন্ধু ড. নাসির জমাদার (জাপানের রিক্কিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর) মাঝে মাঝে তাঁর জাপানি ছাত্রীদের নিয়ে নুহাশপল্লীর গানের আসরে যোগ দিতেন। ছাত্রীদের গাওয়া একটি গান হুমায়ূন আহমেদের এতই মনে ধরল যে তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর টেকরেকর্ডারকে সেই গান শোনাতে বললেন। টেপরেকর্ডার কুসুম পড়ল মহাবিপদে। জাপানি গান। সুর তো ঠিক আছে, কিন্তু একবার শুনে কথা মনে রাখা তো সম্ভব না। জাপানি ছাত্রী ‘আইহারা এরি’-র সাহায্যে গানের কথা লিখে নিয়ে কিছুক্ষণ পর গানটি শোনানো হলো। গানটিতে একটি মজার ব্যাপার ছিল। প্রত্যেক লাইনের পর হাতে তালি কিংবা মেঝেতে পা দিয়ে বাড়ি দিয়ে উপস্থিত সবাইকে গানে অংশ নিতে হতো। হুমায়ূনের নিয়মিত গানের আসরে যুক্ত হয়ে গেল জাপানি গানটি।
‘শিয়া ওয়াসসে নারা তেও তাতাকো
(দুইবার হাতে তালি)
শিয়া ওয়াসসে নারা আসি নারাসো
(পা দিয়ে দুইবার মেঝেতে বাড়ি)
শিয়া ওয়াসসে নারা তাই দোদে শি মেসোয়ো
হোরা মিন নাদে আসি নারাসো
(পা দিয়ে দুইবার মেঝেতে বাড়ি)’
বাংলা, ইংরেজি, জাপানি গান ছাড়া পুরানো দিনের হিন্দি গানও খুব পছন্দ ছিল গানপাগল হুমায়ূনের। ‘দিদার’ ছবির ‘বাচপানকে দিন ভুলানা দেনা,’‘চামানমে রেহকে ভিরানা’ ‘বৈজু বাওয়া’ ছবির ‘দূর কোয়ি গায়ে দুনিয়া শুনায়ে’ সহ আরো অনেক হিন্দি গানই মুখস্থ রাখতে হতো তাঁর ব্যক্তিগত চলমান টেপরেকর্ডারকে যে-কোনো সময় তাঁকে শোনানোর জন্য। ‘তেরে ঘরকে সামনে’ ছবির একটি গান একে বৈঠকে প্রায় ১০-১২ বার শুনতেন। একদিন বসে গেলেন গানটির বাংলা করতে।
তেরে ঘরকে সমনে
এক ঘর বানাউঙ্গা
তেরে ঘরকে সামনে
দুনিয়া সাজাউঙ্গা
হুমায়ূন লিখলেনÑ
তোমার ঘরের সামনে
ছোট্ট ঘর বানাবোগো
তোমার ঘরের সামনে
দুনিয়া সাজাবোগো

(এই গানটি পরবর্তীতে ‘যে থাকে আঁখিপল্লবে’ নামক গানের অ্যালবামে এস আই টুটুল এবং আমার কণ্ঠে দ্বৈতভাবে গীত হয়।)

কয়েক বছর আগে হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বলতে শুরু করলেন, তুমি আমার লেখা গানে সুর করছ না কেন? আমি বোঝাতে চাইলাম এই ভয়ংকর কঠিন কাজটি আমার দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বললেন, আমি নিশ্চিত তুমি চমৎকার সুর করবে।
শাওন
তোমার সুর করার জন্যে
প্রথম গান
১৫-৫-২০০৮
(দখিন হাওয়া)
Humyen-Ahmed
দীঘির জলে কার ছায়াগো?
তোমার নাকি আমার?
তোমার কি আর মন চায় না
এই কথাটা জানার?

বন পারুলের ফুল ফুটেছে
সুবাস আসে ঘরে
সেই সুবাসে শরীর কাঁপে
মন যে কেমন করে।

সাঁঝের বেলায় নেমে আসে
মধ্যরাতের আঁধার।
আমি চলে যাই নদীর কাছে
দাঁড়াই বসি
সময় হলো কাঁদার।

কেন কাঁদি যখন তখন
ইচ্ছে করে জানান?
নদীর জলে কার ছায়াগো
তোমার নাকি আমার?

হুমায়ুন আহমেদ
মূলভাব
[মেয়েটি তার আবেগের কথা জানাতে চাচ্ছে।]

হুমায়ূন আহমেদ সবাইকে চমকে দিতে পছন্দ করতেন। আমাকে চমকে দেওয়া তিনটি ঘটনা পাঠকদের জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না।

ঘটনা-১: একবার একটি কলেজের প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পূর্তিতে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন প্রধান অতিথি। কলেজের নাম ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজ। প্রধান অতিথির স্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের দর্শকসারিতে আমি, ভোঁতামুখে বসে বক্তৃতা শুনছি। সবার শেষে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতে মজার মজার অনেক কথা বললেন হুমায়ূন। এমনকি আগের রাতে হওয়া আমাদের ঝগড়ার কথাও বলে ফেললেন। একপর্যায়ে আমাকে অবাক করে দিয়ে মঞ্চে ডাকলেন তাঁর প্রিয় জাপানি গানটি সবাইকে শোনানোর জন্যে। গানের অর্থ ‘সুখী যদি হতে চাও হাতে তালি দাও।’ এই তথ্য সবাইকে যেমন জানালেন, তেমনি গানের কোন জায়গায় হাতে তালি কিংবা মেঝেতে বাড়ি দিতে হবে তাও বুঝিয়ে দিলেন। হলভর্তি প্রায় আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রী যখন একসঙ্গে গানের ফাঁকে ফাঁকে মেঝেতে পা দিয়ে বাড়ি এবং হাতে তালি দিচ্ছিল তখন এক অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।

ঘটনা-২: ২০০৮ সালে বেক্সিফেব্রিকস-অন্যদিন ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমি গান গেয়েছিলাম। ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়’ গানে শুরুতেই দর্শকসারিতে চোখ পড়ল। দেখলাম প্রথম সারিতে বসে হুমায়ূন, মিটিমিটি হাসছেন, কী আশ্চর্য! অনেক অনুরোধ করেও তো তাঁকে কোনো অনুষ্ঠানে নেওয়া যায় না। গান শেষে তাঁর পাশে গিয়ে এ কথা বলতেই জানালেনÑ ‘দর্শকসারিতে বসে তোমার গান শুনতে কেমন লাগে তা দেখতে চলে এলাম।’
তাঁকে দেখে আয়োজকরা মহাখুশি। এর পরের বছরগুলোতেও একই অনুষ্ঠানে গান গাইবার আমন্ত্রণ পেয়ে বুঝলাম, শুধু আমার গান নয়, গানে টানে অনুষ্ঠানে যাওয়া হুমায়ূনকেও তাদের প্রয়োজন।

ঘটনা-৩: ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত একটি সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে গান গাইছিলাম আমি। দেশ টিভির ‘কলের গান।’ টেলিফোনে বিভিন্ন গানের অনুরোধ পাঠাচ্ছেন দর্শক। হঠাৎ একজন দর্শকের গলা শুনে চমকে উঠলাম।

‘আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমি নিষাদের মা’র কাছে একটি গানের অনুরোধ করতে চাই। গানটি হলো...।’

হুমায়ূন-শাওনের শেষ আনন্দময় গানের আসরটি বসেছিল মেরিল্যান্ডের এক বাসায়। শ্রোতা ছিলেন প্রবাসী লেখক মুনিয়া মাহমুদ ও তাঁর স্বামী নুরুদ্দিন মাহমুদ, হুমায়ূন আহমেদের ছেলেবেলার বন্ধু ফানসু মণ্ডল ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্ন ভাবী, গৃহকর্তা নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া, প্রবাসী পরিচালক সাইফুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পছন্দের গানগুলোর ইতিহাস বলছেন এবং পরক্ষণেই তাঁর টেপরেকর্ডার, আমি সেই গানটি গেয়ে শোনাচ্ছি। ১৯০৫ সালে রেকর্ডকৃত প্রথম গানটি নিধুবাবুর টপ্পা, রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান এবং হুমায়ূন সঙ্গীত হলো। আমাদের প্রায় সব গানের আসর মৃত্যুসংগীত দিয়ে শেষ হলেও হুমায়ূন আহমেদ অসুস্থ হওয়ার পর থেকে ওই বিশেষ গানটি আমি গাইতে চাইতাম না।

পাঠকের যেমন মৃত্যু হয়, শ্রোতারও মৃত্যু হয়।
অতি প্রিয় গান একসময় আর প্রিয় থাকে না। তবে কিছু
গান আছে, কখনো তার আবেদন হারায় না। আমার
কাছে মরমি কবি গিয়াসউদ্দিনের একটি গান সে রকম।
ওল্ড ফুলস ক্লাবের প্রতিটি আসরে একসময় এই গান
গীত হতো। শাওনের প্রবল আপত্তির কারণে এই গান
এখন আর গীত হয় না। গানটির শুরুর পঙক্তিÑ

মরিলে কান্দিস না আমার দায়
ও জাদুধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়।

নিউইয়র্কের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ, হুমায়ূন আহমেদ, পৃষ্ঠা-৫৯

কিন্তু সেদিন হুমায়ূনের গানটি শোনার প্রবল ইচ্ছার কাছে হার মানলাম। গান শুনে প্রথম দিনের মতো কাঁদলেন তিনি।

এরপর আর গান শোনানো হয়নি তাঁকে। দ্বিতীয়বার অপারেশনের সাত দিন পর ফুসফুসে ভাইরাস সংক্রমণের কারণে তাঁকে মেশিনের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নিতে হয়। প্রক্রিয়াটি অস্বস্তিকর বলে বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। সারা দিনে কেবল ১-২ ঘণ্টার জন্য তাঁর ঘুম ভাঙত। মুখে নল থাকার কারণে কথা বলতে না পারলেও আমাদের সব কথা শুনতে ও বুঝতে পারতেন তিনি। সেই সময়টাতে তাঁর সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম, তাঁর সাথে কথা বলতাম। নুহাশের কথা, নিষাদের কথা, নিনিতের কথা, নুহাশপল্লীর তাঁর প্রিয় গানগুলোর কথা, আমার কথা। মাঝে মাঝে তাঁর চোখ বেয়ে পানি পড়ত। তাঁর হাত দিয়ে শক্ত করে ধরতেন আমার হাত। একদিন দেখলাম পাশের রুমে কোমায় থাকা এক রোগীকে নার্স গুনগুন করে গান শোনাচ্ছে আর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। ‍জিজ্ঞেস করতেই নার্স জানালেন রোগীকে মিউজিক থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। আচ্ছা, একইভাবে গান শুনিয়ে হুমায়ূন আহমেদকেও আমিও তো থেরাপি দিতে পারি। কিন্তু সেই সুযোগ আর দিলেন না হুমায়ূন। ১৯ জুলাই নীরব নিথর হুমায়ূনের সাথে ডাক্তাররা যখন আমাকে এক কিছুটা সময় কাটাতে দিলেন তখন...।

না। আমাকে দেওয়া গুরুদায়িত্ব পালনে তাঁর শবদেহের পাশে বসে ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটি ধরতে পারি না। হুমায়ূনের টেপরেকর্ডার বিকল হয়ে গেছে সেদিন থেকে।

‘অন্যদিন’-এর হুমায়ূন আহমেদ স্মরণসংখ্যার সৌজন্যে।
Share this article :
WELCOME to my 1st Bangla blog site. We can give all Exclusive news as soon as possible.

BREAKINGN NEWS

 
Helped By : WWW.KASPERWINDOW.TK | KasperWindowTemplate | Download This Template
Copyright © 2011. All INFO Zone - All Rights Reserved
Template Created by Aehtasham Aumee Published by KasperWindow
Proudly powered by Blogger